Search This Blog

Kaler Kontho report on Hotel Purbani ownership conflicts

সর্বশেষ
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনায় রবিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি

¦
হোটেল পূর্বাণীর জমির দিকে 'কুনজর'
ভূমি সংস্কার বোর্ডের!
 আপেল মাহমুদ
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত হোটেল পূর্বাণীর জমি দখল করার জন্য একটি মহলের সক্রিয় হয়ে ওঠার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি পুলিশ নিয়ে হোটেলের সামনে জোর করে মালিকানার দাবিসংবলিত সাইনবোর্ড টাঙানোর চেষ্টা করেন ভূমি সংস্কার বোর্ডের আওতাধীন ঢাকার নওয়াব এস্টেটের কর্মকর্তারা।
প্রায় অর্ধশতাব্দীর প্রাচীন এবং বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত দেশের প্রথম অভিজাত হোটেল পূর্বাণী দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় ১.৩৭৬৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। শুরু থেকেই তা পরিচালনা করে আসছে বাংলাদেশ হোটেলস লিমিটেড নামের একটি কম্পানি। স্বাধীনতার আগে যার নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান হোটেলস লিমিটেড। এই কম্পানির ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের এ জমির ওপর ভূমি মন্ত্রণালয় এবং ভূমি সংস্কার বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার 'কুনজর' পড়েছে বলে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়।
রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন ডিআইটি (ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট) জমি অধিগ্রহণ করে মতিঝিল ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলে। এর মধ্যে ১৯৬২ সালের ২০ আগস্ট ১ নম্বর দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার ১.৩৭৬৫ একর প্লটটি দীর্ঘমেয়াদি লিজ দেওয়া হয় বাংলাদেশ হোটেলস লিমিটেডকে। এজন্য দুই পক্ষের মধ্যে রেজিস্টার্ড লিজ ডিডও সম্পাদন করা হয়। লিজ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯৬৮ সালে ওই প্লটে পূর্বাণী হোটেল গড়ে তোলা হয়। ১৯৬০ সালের লে-আউট ম্যাপেও ১ নম্বর দিলকুশা প্লটটি আবাসিক হোটেলের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দীতে অন্য কেউ ওই প্লটের মালিকানা দাবি করেনি বলে পূর্বাণী কর্তৃপক্ষ জানায়। কিন্তু হঠাৎ করেই গত ৫ এপ্রিল ভূমি সংস্কার বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন কোর্ট অব ওয়ার্ডস ঢাকা নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজার মোহাম্মদ সহিদ উল্লাহ মজুমদার ১০ দিনের মধ্যে ওই প্লট তাঁদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নোটিশ প্রদান করেন। নোটিশের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ১৬ এপ্রিল। কিন্তু নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজার সহিদ উল্লাহ মজুমদারের অতি উৎসাহে মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় দিন আগেই গত ৯ এপ্রিল এস্টেটের ১৫-২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মতিঝিল থানার ফোর্সসহ দারোগা মো. মোস্তাফিজুর রহমান হোটেল পূর্বাণীর সামনে মালিকানা দাবিসংবলিত সাইনবোর্ড লাগানোর চেষ্টা করেন। সাইনবোর্ড টাঙানোর জন্য তাঁরা চারজন লেবার, সিমেন্ট-বালু, খোয়া, খন্তা-কোদাল সঙ্গে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বাণীর যে জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদস্বরূপ পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়েছিলেন, ঠিক সেই জায়গায় তাঁরা 'এ জমির মালিক কোর্ট অব ওয়ার্ডস' লেখা সাইনবোর্ড পুঁততে থাকেন। তখন এলাকার লোকজন ও হোটেলের কর্মচারীরা বাধা দিলে তাঁরা সেখান থেকে চলে যান।
এ বিষয়টিকে চর দখলের সঙ্গে তুলনা করে হোটেল পূর্বাণীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান জয়নাল বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি জালিয়াতচক্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসব অপতৎপরতা চালাচ্ছে। মূলত তারা বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য হোটেল পূর্বাণীর জমি নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। নোটিশের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেন পূর্বাণীর জমি দখল করার জন্য যাওয়া হলো- কালের কণ্ঠের এ প্রশ্নের জবাবে সদুত্তর দিতে পারেননি নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজার সহিদ উল্লাহ মজুমদার। সাইনবোর্ড লাগানোর চেষ্টার পরদিন ১০ এপ্রিল পূর্বাণীর পক্ষে একটি রিট পিটিশন করা হলে নওয়াব এস্টেটের দেওয়া নোটিশের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
আদালতের নির্দেশনা, ম্যাজিস্ট্রেট এবং কোনো রকম চূড়ান্ত নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ করে ঐতিহ্যবাহী একটি হোটেলের জমি দখলের চেষ্টায় স্থানীয় লোকজন হতবাক হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের একজন পৃষ্ঠপোষক এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আবদুস সাত্তারের প্রতিষ্ঠিত হোটেল পূর্বাণী সরকারি জমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে- এ অভিযোগ তাঁরা মানতে নারাজ। এ ব্যাপারে মতিঝিলের প্রবীণ ব্যবসায়ী এবং মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বলেন, পুরান ঢাকার খ্যাতিমান ব্যক্তি কাদের সর্দারের সঙ্গে আবদুস সাত্তারের নাম উচ্চারিত হতো। তিনি শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যে কারণে তাঁদের অনেক গোপন সভা করার জন্য তিনি হোটেল পূর্বাণী বিনা পয়সায় ব্যবহার করতে দিতেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সভা হয়েছিল হোটেল পূর্বাণীতে। পূর্বাণীর কয়েকজন প্রবীণ কর্মচারী জানান, একাত্তরের আগে শেখ মুজিবুর রহমান হোটেল পূর্বাণী প্রাঙ্গণে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজার সহিদ উল্লাহ মজুমদার বলেন, মতিঝিল ও দিলকুশায় তাঁদের অনেক সম্পত্তি বেহাত অবস্থায় আছে। বর্তমানে সেগুলো চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে হোটেল পূর্বাণীতে তাঁরা সাইনবোর্ড টাঙাতে যান। তিনি দাবি করেন, সিএস, এসএস, আরএস ও মহানগর জরিপ অনুযায়ী হোটেল পূর্বাণীর ০.৯৯৯২ একর জমির মালিক নওয়াব এস্টেট। ওই জমিতে হোটেল পূর্বাণী নির্মাণ করে অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এ জমি যে পাকিস্তান আমলে অধিগ্রহণ করে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সে তথ্য জানা আছে কি না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ কথা তাঁদের জানা নেই। তবে সব কাজগপত্র নিয়ে আসার জন্য পূর্বাণী কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পূর্বাণী কর্তৃপক্ষ এ চিঠি দেওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
পূর্বাণীর নিয়োজিত আইনজীবী কাজী রেজাউল হোসেন বলেন, ১০ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট পিটিশন করার পর নওয়াব এস্টেটের দেওয়া নোটিশের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশেদ আলম সরকারের বেঞ্চ। অথচ বিচারাধীন বিষয়ের ওপর নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজার নতুন করে পূর্বাণী কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বিভিন্ন তথ্য চাচ্ছেন। তা ছাড়া নওয়াব এস্টেটের পক্ষে মতিঝিল থানায় গত ১৩ এপ্রিল একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে, যা আদালত অবমাননার শামিল বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, কোর্টের কোনো রকম নির্দেশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া একটি স্বনামধন্য অভিজাত হোটেল দখল করতে যাওয়া ছিল তাঁদের বেআইনি কার্যকলাপ। এদিকে বাংলাদেশ হোটেলস লিমিটেডের পরিচালক আবদুল মোহাইমেন হোটেল পূর্বাণীর বিরুদ্ধে লেখা চিঠি এবং মতিঝিল থানায় করা সাধারণ ডায়েরি প্রত্যাহারের জন্য গত সোমবার একটি চিঠি দিয়েছেন নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজারকে। তা প্রত্যাহার করা না হলে তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে বলে জানান পূর্বাণীর আইনজীবী কাজী রেজাউল হোসেন।
মতিঝিল এসিল্যান্ড অফিস সূত্রে জানা যায়, হাল সাল পর্যন্ত হোটেল পূর্বাণীর খাজনা পরিশোধ করা হয়েছে। সিএস, এসএ ও আরএস নওয়াব এস্টেটের এবং মহানগর জরিপে নওয়াব হাসান আসকারীর নামে রেকর্ড হওয়া সম্পত্তির খাজনা কিভাবে হোটেল পূর্বাণীর নামে নেওয়া হলো সে ব্যাপারে এসিল্যান্ড তারিকুল আলম বলেন, রাজউকের লিজ ডিডের মাধ্যমে খাজনা নেওয়া হয়েছে। সরকারি কোনো প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পর লিজ ডিডের মাধ্যমেই মালিকানাস্বত্ব প্রমাণিত হয়। সম্প্রতি লিজ ডিডের পরও নামজারি জমা খারিজ করার নিয়ম চালু করা হয়েছে। একাধিক ভূমি কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তান আমলে ডিআইটির প্লটের ক্ষেত্রে লিজ ডিডই মালিকানাস্বত্ব। এরপর যদি কেউ সে প্লটে নিজের নামে রেকর্ড-পরচা করে নেয় তাহলে সেটা হবে জালিয়াতির শামিল। হোটেল পূর্বাণীর ক্ষেত্রে সে রকম প্রতারণামূলক ঘটনাই ঘটেছে হয়তো। বিষয়টি নওয়াব এস্টেটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জানার কথা। তা ছাড়া সরকারি সংস্থা ডিআইটির অধিগ্রহণকৃত বরাদ্দ দেওয়া প্লট আরেকটি সরকারি সংস্থার মালিকানা দাবি করা নজিরবিহীন বলেও তাঁরা বলেন।
ভূমি সংস্কার বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, ১৮৭৯ সালের কোর্ট অব ওয়ার্ডস অ্যাক্ট আইনে সংস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে। তাই এর ধ্যান-ধারণাও সেকেলে। ১৯০৮ সালের ৬ আগস্ট ওই অ্যাক্টের মাধ্যমে ঢাকা নওয়াব এস্টেটের সব সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে নওয়াব এস্টেট নামে অর্পণ করা হয়। তখন ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল জেলায় নওয়াবদের হাজার হাজার একর জমি ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বেশির ভাগ জমিই বেহাত হয়ে যায়। এসব সম্পত্তি বেহাত হওয়ার পেছনে নওয়াব এস্টেটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, অযোগ্যতা, স্বজনপ্রীতি কাজ করেছে বলে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া এস্টেটের হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি লিজ দেওয়ার নামে হাতছাড়া করা হচ্ছে বলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। এসব সমস্যা সমাধান না করে ডিআইটির (রাজউক) বরাদ্দ দেওয়া প্লট দখলের চেষ্টায় নওয়াব এস্টেটের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত মোটা অঙ্কের টাকা খাওয়ার উদ্দেশ্যেই পূর্বাণীর জমি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করা হচ্ছে।
হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ইতিমধ্যে একাধিক ব্যক্তি তাদের কাছে এসে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান নুরুল হকের নামে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দাবি করেছে। এ টাকা দিলে আর ঝামেলা করা হবে না বলে তারা 'নিশ্চয়তা' দেয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ঢাকা শহরে নওয়াব এস্টেটের মালিকানাধীন অনেক মূল্যবান জমি রয়েছে। সেসব জমি খোঁজ করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত একান্ত সচিবরা ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১ নম্বর দিলকুশার এ জমির খোঁজ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জানানো হয়, এই জমি কোর্ট অব ওয়ার্ডের নামে রেকর্ডভুক্ত। পূর্বাণীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজারের পাঠানো নোটিশের কপি ভূমিমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, ভূমি প্রতিমন্ত্রী, ভূমি সচিব এবং ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানকে তা না দিয়ে তাঁদের একান্ত সচিবদের দেওয়া হয়। একান্ত সচিবদের নামে এ ধরনের কপি দেওয়ার ঘটনা রহস্যজনক ও প্রথাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। এসব অভিযোগের সত্যতা জানার জন্য ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান নুরুল হকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। মোবাইল ফোনে কল করলে অপর প্রান্ত থেকে চেয়ারম্যানের নতুন একটি নম্বর দেওয়া হয়। বারবার কল করেও সে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

No comments:

Post a Comment